বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে ন্যূনতম পিএইচডি ডিগ্রি থাকা অত্যাবশ্যক হলেও আমাদের দেশে এর ভিন্নতা দেখতে পাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষকের মধ্যে মাত্র সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে। তার মানে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষকদেরই পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজন রয়েছে, যেখানে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পিএইচডি করার আগ্রহের কথা নাহয় বাদই দিলাম।
বাংলাদেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমোদন থাকলেও কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি দিতে পারে না। বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং ২০২৩-এ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ) পিএইচডি প্রদান করতে পারে না।
পরিসংখ্যানগতভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে, এনএসইউতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের অনুপাত সবচেয়ে বেশি, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষকের একটি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে একটি বিদেশি ডিগ্রি রয়েছে। ইউজিসির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এনএসইউয়ের বার্ষিক গবেষণার সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি।
আরেকটি উদাহরণ হলো, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, যার শিক্ষার্থীরা হার্ভার্ড, ইয়েল ও কলম্বিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ওয়ার্ল্ড ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ এবং নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ জিতেছে। অধিকন্তু, টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ইউনিভার্সিটি ইমপ্যাক্ট র্যাঙ্কিং ২০২২-এ এসডিজি-১–এর জন্য ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ৫০-এ স্থান পেয়েছে।
এনএসইউ এবং ব্র্যাকের মতো শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন স্কলারদের নিয়োগ দিয়ে থাকে, যাঁরা শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি প্রদানের জন্য ভৌত অবকাঠামো, আর্থিক সচ্ছলতা, দক্ষ গবেষক এবং উচ্চশিক্ষিত জনবল রয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আর্থিক এবং ব্যক্তিগত কারণে, অনেক শিক্ষার্থী তাদের পিএইচডি বিদেশের পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্পন্ন করতে চান। এই জাতীয় সমস্যাগুলো নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আরও প্রকট হতে পারে। পারিবারিক, আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতা তাদের বিদেশে পড়াশোনা করাকে সংকুচিত করে দিতে পারে। কারণ, পিএইচডি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এই প্রেক্ষাপটে স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি, বিদেশি শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষার জন্য আসবে, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক পরিচিতির পাশাপাশি র্যাঙ্কিংয়েও উন্নতি ঘটাতে অবদান রাখবে।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যেখানে আমরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অন্যের বই বা রেফারেন্স পরে পরীক্ষায় পাস করে থাকি, কিন্তু নিজেরা কোনো গবেষণা করে জ্ঞান তৈরি করতে পারি না। একজন শিক্ষার্থী তার পিএইচডি গবেষণায় মাধ্যমেই কেবল মৌলিক জ্ঞান তৈরি করে থাকে। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা এত কম হয় যে আমরা আমাদের কোনো বই বা লেখাজোখা শিক্ষার্থীদের রেফার করতে পারি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের বিদেশি লেখকদের বই রেফার করতে হয়, যেখানে উদাহরণ এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ওই বিদেশি সমাজকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। তাই উচ্চতর গবেষণার মধ্য দিয়েই কেবল সব ক্ষেত্রে আমরা নতুন জ্ঞান তৈরি করতে সক্ষম হব এবং পশ্চিমা জ্ঞানের আধিপত্যের মধ্যে আমাদের জায়গা করে নিতে পারব।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেকের মধ্যেই একটি সরলীকৃত অনুমান কাজ করে যে শুধু যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না, তারাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। যদিও এই অনুমানের কিছু সত্যতা রয়েছে, তবে এনএসইউ বা ব্র্যাকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যম থেকে আসে, যারা খুব কমই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এ ছাড়া ব্যাপক হারে আর্থিক সহযোগিতা এবং মেধাবৃত্তির কারণে, অনেক বাংলা মাধ্যম বা মূলধারার মেধাবী ছাত্রছাত্রী যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে সক্ষম, তারা সময়মতো তাদের পড়াশোনা শেষ করার জন্য এনএসইউ, ব্র্যাক বা অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, শুধু আর্থিক সচ্ছলতার জন্যই একজন শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হয় না, অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পছন্দের বিষয় না পাওয়ার কারণেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তার শিক্ষা ও গবেষণার ফলাফল বা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে তার ‘পাবলিক’ এবং ‘প্রাইভেট’ তকমার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের মতামত হচ্ছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল ‘প্রাইভেট’ এবং ‘পাবলিক’ভিত্তিতে বিবেচনা করার যে মানসিকতা, তা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের চিন্তাধারার সঙ্গে উন্নত বিশ্বের পার্থক্য বোধ হয় এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লীগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথাই ধরা যাক, যেখানে হার্ভার্ড, ইয়েল এবং প্রিন্সটন প্রাইভেট হওয়া সত্ত্বেও সেসব প্রতিষ্ঠানের আবেদন বিশ্বের যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনেক বেশি।
উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা এবং শিল্পগোষ্ঠী পিএইচডি গবেষণা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের বড় কোম্পানিগুলো একাডেমিক গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে গবেষণাতেও তেমন বিনিয়োগ করে না। আমরা যদি এই প্রবণতাকে পরিবর্তন করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প–বাণিজ্যখাতের মধ্যে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার রীতি চালু করতে পারি, তাহলে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান বা মানবিক শাখায় আমাদের গবেষণা বৃদ্ধি পাবে। কে জানে অক্সফোর্ড বা পেনসিলভানিয়ার আগে এনএসইউ বা ব্র্যাকই হয়তো পরবর্তী মহামারির প্রথম টিকা উদ্ভাবনে সক্ষম হবে!
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ১৬২টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে, ২৫টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে থাকে। আমরা দাবি করছি না যে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করার অনুমতি দেওয়া উচিত। অন্তত প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যারা শিক্ষা এবং গবেষণায় ভালো করছে, এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডির অনুমতি দেওয়া হোক, যাতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখতে পারে এবং আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে আরও উন্নতি করতে পারে। এ বিষয়ে ইউজিসির নেতৃত্বে একটি কমিটি করে তার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।